আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ, সম্পর্কে বিস্তারিত

আয়োডিন যুক্ত হরমোনের নাম হল "থাইরক্সিন"। আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ গুলো সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার কেননা এর জন্য বড় ধরনের রোগ হতে পারে চলুন আয়োডিনের অভাবে যেসব রোগ হয় তা জেনে নেওয়া যাক।
ছবি
আয়োডিন যুক্ত ফল , আয়োডিন যুক্ত মাছ, আয়োডিন যুক্ত শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি আমাদের খেতে হবে। তাহলে আয়োডিন অভাব পূরণ হবে। তাই আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে জানতে পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

পোস্টসূচিপত্রঃআয়োডিনের অভাবজনিত রোগ, সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

আয়োডিন কি

আয়োডিন হচ্ছে এক প্রকার প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান যার প্রদান উৎস সমুদ্রের পানি। এই পানির বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে আসে। এ মাটিতে উৎপাদিত খাদ্যের মাধ্যমে আমরা আয়োডিন পেয়ে থাকি। থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিন বিশেষ প্রয়োজন।থাইরয়েড গ্ল্যান্ড এর মাধ্যমে এই থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়।

গলার সামনের দিকে প্রজাপতি আকারের এই গ্ল্যান্ড অবস্থিত, এর মাধ্যমে চলাচল করে দেহের বিভিন্ন অংশের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই শরীরের আয়োডিনের অভাব হলে দৈহিক বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশ ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আপনার শরীরে আয়োডিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি গ্রহণ করতে হবে, তাহলে আয়োডিনের অভাব মুক্ত হবে।

আয়োডিনযুক্ত খাবার এর উপকার কি

  • শিশুর বোধশক্তি ও বুদ্ধি ক্ষমতার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে
  • মানুষ কর্মউদ্যোগী ও প্রাণোচ্সছল থাকবে
  • শিশুর বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে
  • গর্ভবতী মায়ের ভ্রুনের আয়োডিনের অভাব পূরণ হবে। ফলে শিশুর শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।সুস্থ সবল শিশু জন্ম হবে এবং গর্ব অবস্থায় শিশুর মৃত্যুর হার কমে যাবে
  • বামন, বোবা ,কালা ,টেরা ইত্যাদি শিশুর সংখ্যা কমে যাবে
  • শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ঘটবে
  • গলগন্ড বা ঘ্যাগ হবে না

আয়োডিনের অভাবজনিত রোগের নাম

নিম্নে আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো,

১. মানসিক প্রতিবন্ধীঃ খুব ছোট শিশুরা আয়োডিনের অভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী তে পরিণত হতে পারে। অনেক সময় মানসিক প্রতিবন্ধীতা খুবই মারাত্মক হয়ে থাকে, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এটা এত মৃদু থাকে যে খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবে না।

যেমন একটি শিশু দেখতে শুনতে স্বাভাবিক কিন্তু কাজে বা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না বা দেরি হয়। বাবা-মায়েরা তা বুঝতে পারেন না। এটিও আয়োডিন অভাবের একটি লক্ষণ ,যেসব শিশু আয়োডিন অভাবে ভোগে না তাদের 
তুলনায় যেসব শিশু আয়োডিনের অভাবে ভোগে তারা কম বুদ্ধি সম্পন্ন হয় ।এর সাথে শিশু বোবা , কালা এবং বামনও হয়ে থাকে ।যখন একজন গর্ভবতী মা মারাত্মক আয়োডিন অভাবে ভোগেন তখন তার হাবাগোবার সন্তানের জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

ভ্রুনের বৃদ্ধির বিশেষ পর্যায়ে গর্ভস্থ ভ্রন যথেষ্ট পরিমাণে আয়োডিন না পেলে শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের এই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকে।

২. প্রজনন সমস্যাঃ যেসব মহিলা আয়োডিন ঘাটতি আছে তাদের অন্যান্য মহিলার চাইতে গর্ভপাত ও মৃত কিংবা বিকলাঙ্গ সন্তানের প্রসবের ঝুঁকি বেশি থাকে। বেশিরভাগ মহিলায় বুঝতে পারেন না যে আয়োডিনের অভাব এর প্রধান কারণ।

৩. শিশু মৃত্যুঃ আয়োডিনের অভাবগ্রস্থ শিশুরা অন্যান্য শিশুদের চাইতে অধিক মাত্রায় অপুষ্টি সমস্যায় ভোগে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে আয়োডিন অভাবে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৪. গলগন্ড বা ঘ্যাগঃ গলগন্ড হলো স্বাভাবিক আকারের চাইতে বড় থাইরয়েড গ্ল্যান্ড এবং আয়োডিনের অভাবে এই লক্ষণটি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। যাদের আয়োডিন ঘাটতি আছে তাদের ঘ্যাগ বা গলগন্ড রোগ দেখা দেয়।

কারণ তাদের যথেষ্ট পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড এই অভাব পূরণের জন্য অতিরিক্ত কাজ করে ।যার ফলে এই গ্ল্যান্ডটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। শরীরে আয়োডিনের ঘাটতির একটি বড় ধরনের লক্ষণ হল এই গলগন্ড।

৫. হাইপো থাইরয়েডিজম বা শরীরে পর্যাপ্ত আয়োডিন না থাকাঃ শরীর পর্যাপ্ত আয়োডিন না পেলে যথেষ্ট পরিমাণ থাইরক্সিন হরমোন তৈরি হবে না ।ফলে শরীর অলসতা পেয়ে পেয়ে যাবে , ক্ষুধামন্দা হবে , চামড়া খসখসে হবে , অনিদ্রা দেখা দিবে , এসব সমস্যা তৈরি হলে তার কর্ম ক্ষমতা কমে যাবে।

আয়োডিন কোথায় পাওয়া যায়

আয়োডিনের প্রধান উৎস সমুদ্রের পানি। আমরা প্রাকৃতিকভাবে মাটি ও পানি হতে এই আয়োডিন পেয়ে থাকি যা বৃষ্টির মাধ্যমে সমুদ্র হতে মাটিতে আসে। যেসব প্রাণী ও উদ্ভিদ এই মাটি বা পানি হতে খাদ্য সংগ্রহ করে তাদের মাধ্যমে আয়োডিন পাওয়া যায়। সমুদ্রের মাছ রূপচান্দা ,লইট্টা ,ছুরি করাল ইত্যাদি মাসে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন বিদ্যমান, এইসব মাছের ফুলকাতে আয়োডিন থাকে।

বাংলাদেশের মাটিতে কেন আয়োডিন কম থাকে

বাংলাদেশের প্রতিবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত ও বন্যার ফলে মাটি থেকে এই আয়োডিন ধুয়ে নদনদীর মাধ্যমে চলে যাচ্ছে সেই সমুদ্রে ।ফলে আমাদের খাদ্যে ক্রমশঃ আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে । বর্তমানে বাংলাদেশের খাবারের আয়োডি নেই বললেই চলে ।

আয়োডিন অভাবজনিত রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে

আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ এর জন্য প্রতিরোধ করতে হবে। আয়োডিন ঘাটতি জনিত সমস্যার সমাধানের জন্য খাদ্য অবশ্যই বাড়তি আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে।

আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা প্রতিরোধের উপায় হল প্রতিদিনই আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া এবং সবসময় তা পরিবারের সবাই গ্রহণ করা। আয়োডিন দেহে বেশি পরিমাণে সংরক্ষণ করা যায় না তাই 
নিয়মিত এবং অল্প পরিমাণ আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে ।প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়োডিন গ্রহণ করলে তা প্রসবের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। গৃহপালিত পশু পাখিকেও আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়ানো উচিত, এতে তাদের দেহে পুষ্ট হবে সুস্থ বাচ্চা প্রসব করবে।এবং এতে মাংস ,দুধ ,ডিম বেশি পাওয়া যাবে।

আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার ও সংরক্ষণ

যেভাবে আমরা সাধারণ লবণ গ্রহণ করি ঠিক সেভাবেই আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ করতে হবে। আয়োডিনযুক্ত লবণ রান্নায় এবং খাবারে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতে হবে। লবণ কেনার সময় অবশ্যই আয়োডিনযুক্ত লবণের প্রতীক চিহ্ন দেখে নিতে হবে।

স্বাভাবিক রান্নায় লবণের আয়োডিন হ্রাসের পরিমাণ খুবই কম ।তবে রান্নার শেষ মুহূর্তে লবণ ব্যবহার করা উচিত। বাজারে খোলা লবণ কেনা উচিত না, লবণ গলে গেলে তাতে আয়োডিন থাকে না।

আয়োডিনযুক্ত খাবার গুলোর নাম কি

দুধঃ দুধে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের জন্য অত্যন্ত ভালো একটি উৎস । এক কাপ দুধে ৫৬ মাইক্রগ্রাম আয়োডিন বিদ্যমান থাকে। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়োডিনের প্রয়োজনটা দুধ মেটাতে পারে। তাই প্রতিদিন আমরা দুধ পান করব।

সামুদ্রিক শৈবালঃ সামুদ্রিক শৈবালে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে, আপনার প্রতিদিনের যে আয়োডিন চাহিদা পূরণের জন্য আপনি সামুদ্রিক শৈবাল খেতে পারেন ।আপনি জেনে অবাক হবেন যে ,৭ গ্রাম শুষ্ক সামুদ্রিক শৈবালে আয়োডিন আছে ৪৫০০ মাইক্রগ্রাম। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে আরও মাছ রয়েছে সেগুলো হল, ইলিশ, টুনা মাছ, স্যামন মাছ ,কট ফিস, হেরিং ইত্যাদি।

পাউরুটিঃ প্রতিদিন আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পাউরুটি একটি উৎস হতে পারে। মাত্র দুই টুকরো সাদা পাউরিটিতে ২৫ মাইক্রগ্রাম আয়োডিন রয়েছে যা আপনার আয়োডিনের দৈনিক চাহিদার ৩০% পূরণ করতে পারে।

গলদা চিংড়িঃ আয়রনের চাহিদা মেটাতে গলদা চিংড়িও হতে পারে আপনার একটি উৎস। আপনি প্রতিদিন ১০০ গ্রাম গলদা চিংড়ি খেতে পারেন কারণ ১০০ গ্রাম গলদা চিংড়িতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে। যদিও গলদা চিংড়ি কেনা সবার সাধ্য নয় অনেক দাম হওয়ার কারণে।

স্ট্রবেরিঃ একটি স্ট্রবেরিতে ১৩ গ্রাম আয়োডিন রয়েছে, যদি আপনার সামর্থ্য থাকে তাহলে প্রতিদিন স্ট্রবেরি খেতে পারেন

দইঃ টক দই আপনার আয়োডিনের উৎস হতে পারে ১ কাপ টক দইয়ে ৯০ গ্রাম পরিমাণ আয়োডিন রয়েছে । আপনি চাইলে প্রতিদিন ১ গ্রাম টক দই খেতে পারেন।

সিদ্ধ ডিমঃ প্রতিদিন আপনি ডিম খেতে পারেন কেননা ডিম আয়োডিনের একটি প্রদান উৎস। একটি সিদ্ধ ডিমের ১২ মাইক্রগ্রাম আয়োডিন থাকে ,এছাড়াও ডিমে ভিটামিন প্রোটিন ক্যালসিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর একটি ভালো উৎস । আপনি প্রতিদিন একটি ডিম খেতে পারেন।
ভুট্টাঃ আপনার দিনের খাদ্য তালিকায় ভুট্টা রাখতে পারেন কেননা ভুট্টা আয়োডিনের একটি অন্যতম উৎস ।আধা কাপ ভুট্টা আপনি পাবেন ১৪ মাইক্রগ্রাম আয়োডিন,

তাই আজ থেকেই আপনার খাদ্য তালিকায় নজর রাখুন যে সঠিক পরিমাণ আয়োডিন প্রতিদিন আপনার পরিবারের সবাই গ্রহণ করছে কিনা।

লবণের আয়োডিন পরীক্ষা

লবন আয়োডিন পরীক্ষা করার জন্য আয়োডিন টেস্টিং কিট ব্যবহার করা যায়।তাছাড়া বাড়িতে বসেও নিজে নিজেই লবণ আয়োডিন উপস্থিত পরীক্ষা করা যায়। নিম্নে সেটার বিস্তারিত আলোচনা করা হলো কিভাবে আপনি সহজে ঘরে বসে লবণ আয়োডিন পরীক্ষা করতে পারেন।
  • এক চা চামচ পরিমাণ লবণ নিন এবং চামচের উপরের বাড়তি লবণ আঙ্গুল দিয়ে ফেলে দিন
  • একটি পরিষ্কার প্লেটে লবণ নিন
  • পাঁচটি ভাতের দানা নিন। লক্ষ্য রাখুন যেন পাঁচটির বেশি ভাতের দানা না হয়।
  • ভাতের দানা লবণের সাথে ভালোভাবে চটকে নিন এবং প্লেটের মাঝখানের সমান ভাবে ছড়িয়ে দিন
  • লবন মেশানো ভাতের উপর দুই ফোঁটা লেবুর রস দিন এবং লক্ষ্য করুন যদি লবণের রং বেগুনি হয় তাহলে আপনার লবণে আয়োডিন আছে
লবণ রোদে কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতে রাখলে আয়োডিনের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। এজন্য লবণ সর্তকতার সাথে সংরক্ষণ ও প্যাকেট করতে হবে এবং লবণে আয়োডিনের পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখতে হবে ।আয়োডিনযুক্ত লবণ সূর্য রশ্মির থেকে দূরে ঢাকনাযুক্ত কাঁচের বয়াম বা প্লাস্টিকের পা্ত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।

আমাদের শেষ কথা

আমরা ইতো মধ্য জেনেছি যে দেহে বেশি পরিমাণ আয়োডিন সংরক্ষণ করা যায় না। তাই আমাদের প্রয়োজন প্রতিদিন ১৫০ মাইক্রগ্রাম আয়োডিন ।আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ লবণ খায় তাতে সাধারণত এই পরিমাণ আয়োডিন থাকে, শুধুমাত্র রান্না করা খাবার থেকেই ১৫০ গ্রাম আয়োডিন পাওয়া যাবে। আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ হলে অতি শীঘ্র চিকিৎসা নিবেন। পোস্টা পড়ে যদি ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই বন্ধু-বান্ধবের মাঝে শেয়ার করবেন। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এম আর মাহমুদ ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪